বিদেশি শক্তির যে চাপই আসুক না কেন, জনগণের স্বার্থে যা করা দরকার, সরকার তা করবে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সোমবার(১৩ মার্চ) গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “এমন কোনো চাপ নাই, যেটা শেখ হাসিনাকে দিতে পারে, এটা মাথায় রাখতে হবে। কারণ, আমার শক্তি একমাত্র আমার জনগণ; আর উপরে আল্লাহ আছে; আর আমার বাবার আশির্বাদের হাত আমার মাথায় আছে।
“কাজেই, কে কি চাপ দিল, না দিল- এতে কিছু আমাদের আসে যায় না। জনগণের স্বার্থে যেটা করার আমরা সেটাই করব। জনগণের কল্যাণে যেই কাজ করার সেটাই করব।”
এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর সম্মেলন যোগ দেওয়ার অভিজ্ঞতা জানাতে এই সংবাদ সম্মেলনে আসেন প্রধানমন্ত্রী। বরাবরের মতই তিনি সমসাময়িক নানা বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেন।
গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে ‘হয়রানি’ বন্ধের আহ্বান জানিয়ে সম্প্রতি ওয়াশিংটন পোস্টে বিজ্ঞাপন আকারে প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটি খোলা চিঠি ছাপা হয়। ওই চিঠির সূত্র ধরে এক সাংবাদিক জানতে চান, আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সরকারপ্রধান কোনো আন্তর্জাতিক চাপ অনুভব করছেন কিনা বা আন্তর্জাতিক কোনো চাপ আছে কি-না।
প্রশ্ন শুনে হেসে ওঠেন শেখ হাসিনা। পরে কোনো চাপে নতি স্বীকার না করার বিষয়ে নিজের বক্তব্য তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, “এই রকম বহু চাপতো ছিল, পদ্মাসেতুর আগেতো কম চাপ দেওয়া হয়নি। কোনো একটা দেশের একেবারে সেই অ্যাম্বাসেডর থেকে শুরু করে, তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে টেলিফোনের উপর টেলিফোন, হেনতেন…
“কেন? একটা ভদ্রলোক একটি ব্যাংকে এমডি, তাকে এমডি পদে রাখতে হবে। এমডি পদে কী মধু, তাতো আমি জানি না। আইনে আছে ৬০ বছর, হয়ে গেছে ৭০ বছর বয়স। তারপরেও এমডি পদে থাকতে হবে। একটাই হয় এমডি পদে থাকবে বোধহয় মানি লন্ডারিং করা যায়, এইতো সুবিধা। পয়সা বানানো যায়, পয়সা মারা যায়, গরীবের রক্ত চুষে খাওয়া যায়।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সেই চাপও কিন্তু শেখ হাসিনা সহ্য করে চলে আসছে। তারপর নিজের পয়সায় পদ্মা সেতু বানিয়ে তাদেরকে দেখালাম, ওই চাপে আমাদের কিছু আসে যায় না। ঠিক আছে? আর কিছু লাগবে?”
ড. ইউনূসকে ‘হয়রানি’ না করার আহ্বান জানিয়ে ওয়াশিংটন পোস্টে বিশ্বের ৪০ ব্যক্তির নামে প্রকাশিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশ্যে লেখা ওই খোলা চিঠিকে ‘অলীক ও বস্তুনিষ্ঠ নয়’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন।
৭ মার্চ প্রকাশিত ওই খোলা চিঠি দেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ৪০ জন রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।
এ চিঠির লেখকদের মধ্যে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান-কি মুন, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন, ভার্জিন গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা স্যার রিচার্ড ব্র্যানসন, মেক্সিকোর সাবেক প্রেসিডেন্ট ভিসেন্তে ফক্স, আয়ারল্যান্ডের সাবেক প্রেসিডেন্ট মেরি রবিনসন, এডওয়ার্ড এম কেনেডির ছেলে টেড কেনেডি জুনিয়র, রবার্ট কেনেডি হিউম্যান রাইটসের প্রেসিডেন্ট কেরি কেনেডি, উইকিপিডিয়ার প্রতিষ্ঠাতা জিমি ওয়েলস, চাথাম হাউজের সাবেক প্রধান নির্বাহী স্যার রবিন নিবলেট রয়েছেন।
ওয়াশিংটন পোস্টে প্রায় এক পৃষ্ঠাজুড়ে বিজ্ঞাপন আকার দেওয়া ওই চিঠিতে ইউনূসের বিভিন্ন পুরস্কার ও কাজের ফিরিস্তি তুলে ধরে বলা হয়, “গ্রামীণ টেলিকম বা গ্রামীণফোনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার মাধ্যমে আর্থিকভাবে লাভবান হননি মুহাম্মদ ইউনূস। বরঞ্চ, নিজের প্রতিষ্ঠিত সংস্থাগুলোর সঙ্গে দারিদ্র-বিরোধী মিশনে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন তিনি এবং ঢাকায় সাদামাটা জীবনযাপন করেন।
“এ কারণে এটা দেখা কষ্টকর যে, অনবদ্য সততার একজন ব্যক্তি অধ্যাপক ইউনূস ও তার জীবনকর্মকে অন্যায়ভাবে আক্রমণ করা হচ্ছে এবং অব্যাহতভাবে হয়রানি ও আপনার সরকার দ্বারা অনুসন্ধান করা হচ্ছে।”
ওই খোলা চিঠির বিষয়ে আরেক প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “এটা বিবৃতি তো না, এটা একটা বিজ্ঞাপন এবং যে ৪০ জনের নাম ব্যবহার করা হয়েছে এবং সেটা আমাদের বিশেষ একজন ব্যক্তির পক্ষে, এটার কী (উত্তর) দেব জানি না, তবে আমার একটা প্রশ্ন আছে।
“আমার প্রশ্নটা হল, যিনি এত নামিদামি, নোবেল প্রাইজপ্রাপ্ত তার জন্য এই ৪০ জনের নাম খয়রাত করে এনে অ্যাডভার্টাইজমেন্ট দিতে হবে কেন? তাও আবার বিদেশি পত্রিকায়। এটাই আমার প্রশ্ন আর কিছু না। যে, অ্যাড দিতে হল কেন?”
ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত ওই চিঠিতে আইনি ‘হয়রানির’ প্রসঙ্গ টেনে বলা হয়, “আমরা আশা করি, টেকসই অগ্রগতির জন্য কীভাবে একটি প্রাণবন্ত নাগরিক সমাজকে পরিচর্যা করা যায়, বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য তার রোলমডেল হিসাবে পুনরায় আবির্ভূত হবে।
“এক্ষেত্রে ভালো প্রাথমিক পদক্ষেপ হতে পারে অধ্যাপক ইউনূসের অর্জনের স্বীকৃতি এবং তিনি যেন কেবল নিজেকে রক্ষার জন্য না লড়ে আপনার দেশ ও বিশ্বের জন্য আরও ভালো কাজ করার ক্ষেত্রে তার প্রাণশক্তি ব্যবহারের দিকে নজর দিতে পারেন, সেই সুযোগ করে দেওয়া।”
এ বিষয়ে শেখ হাসিনা তার উত্তরে বলেন, “যে যাই হোক, আমার দেশে কতগুলি আইন আছে। সেই আইন অনুযায়ী সব কিছু চলবে এবং সেটা চলে। আমাদের বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন। আমরা শ্রমিকদের অধিকার সংরক্ষণ করি, যারা ট্যাক্স ঠিকমত দেয় সেটার আলাদা বিভাগ আছে, ট্যাক্স আদায় করে।
“কেউ যদি এখন এই সমস্ত বিষয়ে কোনো রকম আইনভঙ্গ করে বা শ্রমিকদের কোনো অধিকার কেড়ে নেয়, শ্রম আদালত আছে, সেটা দেখে। এই ক্ষেত্রে আমারতো কোনো কিছু করার নেই সরকার প্রধান হিসাবে।”
“কাজেই এখানে আমাকেই বা কেন বলা হল? এর বাইরে আমি আর কী বলব? পদ্মা সেতু কিন্তু করে ফেলেছি, খালি এইটুকু সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিলাম,” স্মিতহাস্যে বলেন প্রধানমন্ত্রী।
নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করতে ‘উন্মুখ দেশি-বিদেশি এজেন্সি’
বাংলাদেশের নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করতে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় অনেকগুলো এজেন্সি ‘উন্মুখ’ হয়ে আছে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “৪০ জনের নামে আসছে, ওটার পেছনেও কিছু অ্যাম্বিশন আছে, এতে কোনো সন্দেহ নাই। যাদেরই ইচ্ছা, তারা জনগণের কাছে যাবে, নির্বাচন যাতে অবাধ, সুষ্ঠু হয়, তার জন্য, আমি তো আগেই বলে দিলাম, নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কী কী সংশোধনী এনেছি বা কীভাবে সংস্কার করা হয়েছে।”
তিনি বলেন, ২০০১ সালের নির্বাচনের পরের সন্ত্রাস-সংঘাত, ২০০৬ সালের ভোটারবিহীন ভোটার তালিকা এবং ২০০৭ সালের মত নির্বাচন আয়োজনের পথ বন্ধ করতে বিভিন্ন সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
“এখন জনগণের উপর নির্ভর করে, যে জনগণ কীভাবে চায়, আমাদের প্রস্তুতি সবসময় আছে যে, জনগণ যেন স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারে।”
বিগত কয়েকটি উপনির্বাচন এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “মানুষ কি ভোট দিতে পারেনি? পেরেছে তো। নির্বিঘ্নে তারা ভোট দিয়ে গেছে। এই ভোটগুলি নিয়েতো কেউ একটা কথাও বলতে পারেনি। পেরেছে?
“সরকারে থাকলেও যে নির্বাচন সবসময় নির্বিঘ্ন হতে পারে, শান্তিপূর্ণভাবে হতে পারে, অবাধ-নিরপেক্ষভাবে হতে পারে সেটাতো আমরা প্রমাণ করেছি। আর আমাদের কী প্রমাণ করতে হবে? আর কি প্রমাণ করতে হবে, সেটাতো আমার প্রশ্ন?”
‘সংলাপ কার সাথে করব?’
আগামী জাতীয় নির্বাচন ঘিরে বিএনপির সঙ্গে কোনো ধরনের সংলাপের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “সংলাপ কার সাথে করব? আমি ২০১৮ এর নির্বাচনের আগে সংলাপ করেছি, তার রেজাল্টটা কী? নির্বাচনটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা ছাড়া আর কিছুই করেনি। ৩০০ আসনে ৭০০ নমিনেশন দিয়ে নিজেরাই নিজেদেরকে নির্বাচন থেকে সরায়া তারপর নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
“১৫ অগাস্ট আমার বাবা-মার হত্যাকারী, গ্রেনেড হামলা করে আইভি রহমানসহ আমাকে হত্যার চেষ্টা, বোমা রেখে হত্যার চেষ্টা… যারা করেছে আমি তাদের সাথেও বসেছি শুধু দেশের স্বার্থে।”
খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর পর ২০১৫ সালে সমবেদনা জানতে গিয়ে বিএনপিনেত্রীর বাসায় ঢুকতে না পারার ‘অপমানের’ কথাও বলেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে মারা গেল, আমি গেলাম তাকে দেখতে বা একজন সন্তানহারা মাকে সহানুভূতি জানাতে, আমাকে কীভাবে অপমানটা করল? আমার গাড়ি ওই বাড়ির মধ্যে ঢুকতে দেবে না, বড় গেট বন্ধ।
“টেলিফোন করে সময় নেওয়া হয়েছে যে, আমি ওই সময়ে আসব, তারপরেও সেই গাড়ি বন্ধ করল। আমি তখন অলরেডি চলে গেছি। বললাম, ঠিক আছে তাহলে ছোট গেট দিয়ে ঢুকব। আমার গাড়ি যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই ছোট গেট বন্ধ করে দিল।
“তো, এত অপমানের পরে তাদের সাথে আবার কীসের বৈঠক? আমার পরিষ্কার কথা। যারা এটুকু ভদ্রতা জানে না, তাদের সাথে বৈঠকের আর কি আছে?”
উপস্থিত সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে শেখ হাসিনা বলেন, “কেউ পারবেন আপনার বাবা-মার হত্যাকারীর সাথে বৈঠক করতে? আপনাকে যদি ওইভাবে অপমান করে, আপনি পারবেন? কে পারবে?
“যেটুকু সহ্য করেছি, দেশের স্বার্থে জনগণের স্বার্থে, নিজের স্বার্থে না। এটাতো প্রমাণিত, বাংলাদেশের মানুষের জন্য। তারপর আবার এদের সাথে কিসের কথা বলব।”
খালেদা জিয়ার ভাই-বোন ও আত্মীয়স্বজনরা এসে ‘আকুতি’ জানানোর কারণে সাজা স্থগিত করার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “তারপরেওতো, ঠিক আছে অসুস্থ, বয়োবৃদ্ধ, বোন এসে ভাই এসে বোনের জামাই সবাই এসে যখন আমার কাছে আর রেহানার কাছে এসে আকুতি করল, হ্যাঁ তার সাজাটা স্থগিত করে বাসায় থাকার এবং চিকিৎসার সুযোগটা করে দিয়েছি। এইটুকু যে করেছি, সেটাই যথেষ্ঠ।
“যারা বারবার আমাদেরকে হত্যা করে, আমাদের উপরে অপমান করে, সারা বাংলাদেশের কাকে না অপমান করেছে? তারপরেও যে এটুকু সহানুভূতি পাচ্ছে, সেটা আমার কারণে। ওদের সাথে আবার কিসের বৈঠক, কিসের কি? আর কী ক্ষমতা তাদের আছে? সন্ত্রাস করা ছাড়াতো কোনো ক্ষমতা নাই।”
Leave a Reply