ঐতিহ্যের আঞ্চলিক গান, মুনোমুগ্ধকর নৃত্য ও চট্টগ্রামী ভাষার কথামালায় অনুষ্ঠিত হলো জমজমাট ‘চাটগাঁইয়া ঈদ আনন্দ উৎসব ২০২৪’। চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদীঘি চত্বরে নানা রঙয়ের বেলুন উড়িয়ে শনিবার উৎসব উদ্বোধন করেন দৈনিক আজাদী সম্পাদক ও একুশে পদকপ্রাপ্ত গুণীজন এম এ মালেক। পরে বণার্ঢ্য শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। বিশাল শোভাযাত্রায় চট্টগ্রামের ঐতিহ্যের সাম্পান, ঘোড়ার গাড়ী, বিভিন্ন ব্যানার ফেস্টুন প্রদর্শন করে লালদীঘি, টেরিবাজার, আন্দরকিল্লাহ হয়ে পুনরায় লালদীঘি চত্বরে এসে শেষ হয়।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী ৩ বছর ধরে ‘চাটগাঁইয়া ঈদ আনন্দ উৎসব’ নামে নতুন এই আয়োজন শুরু করে আসছেন। এ উৎসব এখন চট্টগ্রামের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সম্মিলনের উৎসবে পরিণত হয়েছে।
শনিবার দুপুর থেকে উৎসবে যোগ দিতে নগরীর নানা প্রান্ত থেকে দলে দলে মানুষ আসতে থাকে। বিকেল গড়াতেই তৈরি হয় উপচে পড়া ভিড়। উৎসবে প্রধান অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। উদ্বোধকসহ অতিথিরা সবাই চট্টগ্রামের ভাষায় বক্তব্য দেন।
উৎসব উদ্বোধনে আরো উপস্থিত ছিলেন উৎসবের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা এম রেজাউল করিম চৌধুরী, চট্টগ্রাম ১১ আসনের সংসদ সদস্য এম এ লতিফ, চট্টগ্রামের পুলিশ কমিশনার কৃষ্ণপদ রায়, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান, প্রগতিশীল নাগরিক সমাজের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা হায়দার আলী চৌধুরী, উৎসব আয়োজন কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও চ্যানেল আইয়ের বিভাগীয় প্রধান চৌধুরী ফরিদ, ডেকোরেশন মালিক সমিতির সভাপতি হাজী মো: সাহাব উদ্দিন, কাউন্সিলর হাসান মুরাদ বিপ্লব, পুলক খাস্তগীর, আব্দুস সালাম মাসুম, রুমকি সেন গুপ্ত, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সাংস্কৃতিক সম্পাদক নাসির উদ্দিন হায়দার, সাবেক ছাত্রনেতা নুরুল আজিম রনি, প্রণব চৌধুরী, বিপ্লব চৌধুরী সহ অনেকই।
গানে গানে আসর মাতিয়ে তুলেন খ্যাতিমান শিল্পী সনজিত আচার্য, কল্যাণী ঘোষ, শিমুল শীল, গীতা আচার্য, মোহাম্মদ হারুন, প্রিয়া মনি, আহসান হাবিবুল আলম, সুপ্রিয়া লাকি ও অনন্যা সেন নীপা। নৃত্য পরিবেশন করে সঞ্চারী নৃত্যকলা একাডেমী, অনুশীলন নৃত্যকলা একাডেমী, গীতাঞ্জলি নৃত্যাঙ্গন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের নেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা সবসময় বলেন এবং আমরাও বলি, ধর্ম যার যার উৎসব সবার। আজ ঈদ উৎসবকে উপলক্ষ করে “চাটগাঁইয়া ঈদ আনন্দ উৎসব” এর আয়োজন করা হয়েছে। এই উৎসবে হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিষ্টান সবাই সামিল হয়েছেন। অর্থাৎ ধর্ম যার যার উৎসব যে সবার সেটি আসলে বাস্তবে রূপায়িত হয়েছে এই উৎসবের মাধ্যমে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে যখন প্রবারণা পূর্ণিমার সময় ফানুস উড়ানো হয় তখন সব সম্প্রদায়ের মানুষ এই উৎসবে সামিল হয়, ছোটবেলা থেকে আমি নিজেও ফানুস উড়ানো উৎসবে সামিল হতাম। একইভাবে যখন দুর্গাপুজা উৎসব হয় তখনও সব সম্প্রদায়ের মানুষ সেখানে সামিল হয়। অর্থাৎ আমরা এখানে হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিষ্টান সবাই মিলেমিশে একাকার।’
পররাষ্ট্র মন্ত্রী আরও বলেন, ‘হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিষ্টান সবার মিলিত রক্তস্রোতের বিনিময়ে আমাদের এই দেশ রচিত হয়েছে, সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে এসে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য। তাই আজকে যারা এই উৎসবের আয়োজন করেছেন তাদের ধন্যবাদ জানাই।’
চট্টগ্রামের ঐতিহ্যের ইতিহাস তুলে ধরে ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা প্রথম জনসভা করে জনসমক্ষে ঘোষণা করেছেন এই লালদীঘির ময়দানে। এর আগে ছয় দফা ঘোষণা করা হয়েছিল, কিন্তু জনসভা করা হয় ছয় দফার ওপরে এই লালদীঘির ময়দানে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা চট্টগ্রাম থেকে প্রথম বঙ্গবন্ধুর পক্ষে পাঠ করেছিলেন এম এ হান্নান। মাস্টারদা সূর্যসেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারসহ অনেককে সাথে নিয়ে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামকে কয়েকদিন স্বাধীন রেখেছিলেন। ১৮৫৭ সালে সুবেদার রজব আলী চট্টগ্রামের প্যারেড গ্রাউন্ডে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই দেশে কোন সাম্প্রদায়িক অপশক্তির স্থান হবে না। কেউ সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করতে চাইলে তাদেরকে প্রতিহত করা হবে, সবসময় করেছি, ভবিষ্যতেও করব। এই দেশে সাম্প্রদায়িকতার কোন স্থান নেই।’
উদ্বোধক এম এ মালেক বলেন, ‘চট্টগ্রাম অনেক দিক দিয়ে এগিয়ে। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা অমূল্য সম্পদ। নতুন প্রজন্মকে ভাষা শেখাতে হবে এই ভাষায় কথা বলতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে, কারণ মায়ের ভাষা চর্চা না করলে সে ভাষা হারিয়ে যায়। চট্টগ্রামী ভাষার জাগরণে চাটগাঁইয়া ঈদ আনন্দ উৎসব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’
অনুষ্ঠানের প্রধান পৃষ্ঠপোষক সিটি মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা এম রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘শিল্পী গানে বলেছেন ‘আঁরা চাটগাইয়া নওজোয়ান’। সত্যি চট্টগ্রামের নওজোয়ানরা সিনা দিয়ে ঠেকিয়ে দে ঝড়-তুফান। বৃটিশ আমলে মাস্টার দ্যা সুর্যসেন চট্টগ্রাম কে ৫দিন স্বাধীন রেখেছিল। চট্টগ্রামের মানুষ আমরা সেই বীরের জাতি। তাই এই চাটগাঁইয়া ঈদ উৎসবের মাধ্যমে আমাদের হাজার বছরের চট্টগ্রামের ইতিহাস সংস্কৃতি আগামী প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে পড়বে এই প্রত্যাশা রাখি।’
সংসদ সদস্য এমএ লতিফ বলেন, ‘মাতৃভাষা মাতৃভূমি ও স্বাধীনতাকে ভালবাসতে হবে। আজ জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কথা বলার মানুষ কম। সংস্কৃতি চর্চা কমে গেছে বলে এই অবস্থা হয়েছে। তাই নতুন প্রজন্মকে চট্টগ্রামী ভাষার চর্চা ও স্বাধীনতার চেতনা ধারণে অগ্রগামী হতে হবে।’
পুলিশ কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় বলেন, ‘চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রাজনৈতিক বীরত্ব ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সুনাম আছে সারা বিশ্বে। আজকের আয়োজন সেই ঐতিহ্যের একটি স্মারক হয়ে থাকবে।’
Leave a Reply