সংবাদ ডেস্ক: রাজধানীতে ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত গত এক বছরে ৪৯০ জনকে অপহরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৪৭ জন নারী ও ১৯৪ জন শিশু। এছাড়া আরো ৪৯ জন অপহৃত হয়। এদের মধ্যে দুজনকে হত্যা করা হয়েছে।
অপহৃত ব্যক্তিদের মধ্যে ৩৪৪ জনকে উদ্ধার করেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। এর মধ্যে নারী ও শিশু ৩১৪ জন। মামলার তথ্য অনুযায়ী, মৃত দুজন বাদে ১৪৪ জন এখনো নিখোঁজ।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) নিয়মিত মাসিক প্রতিবেদনের তালিকা থেকে এসব তথ্য জানা যায়।
ডিএমপির তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে নারী ও শিশু অপহরণের ঘটনায় মোট মামলা হয়েছে ৫২৫টি। এর মধ্যে নারী অপহরণ ২৪৮টি ও শিশু অপহরণ মামলা ২৭৭টি। মামলায় মোট আসামি ছিল ৫৭০ জন। এর মধ্যে ৩২৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এদের মধ্যে নারী অপহরণ মামলায় ১৮২ জন ও শিশু অপহরণ মামলায় ১৪২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গত এক বছরে অপহৃত ১৮৪ জন নারী ও ১৩০ জন শিশুকে উদ্ধার করা হয়।
অপহৃত ব্যক্তিদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যা বেশি। ডিএমপির তথ্য মতে, গত পাঁচ বছরে শুধু ঢাকা মহানগরে নারী ও শিশু অপহরণের দুই হাজার ৩৬৭ মামলা হয়েছে। এর মধ্যে নারী অপহরণের ঘটনায় মামলা এক হাজার ৫১০টি ও শিশু অপহরণ মামলা ৮৫৭টি।
নারী ও শিশু অপহরণের ঘটনা বেশি হওয়ার বিষয়ে ডিএমপির একাধিক থানার ওসি বলেন, নারী ও শিশু অপহরণের ঘটনা তদন্তে দেখা গেছে, বেশির ভাগ ঘটনা প্রেমঘটিত সম্পর্কের কারণে ঘটেছে। এসব ঘটনায় অভিভাবকরা অপহরণ মামলা করে থাকেন। ভুক্তভোগীদের মধ্যে ১৫ থেকে ২৫ বছর বয়সীদের সংখ্যাই বেশি। আর যারা ১৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী, তাদের ক্ষেত্রে শিশু অপহরণ মামলা হয়ে থাকে।
উদ্ধার করা বেশির ভাগ ব্যক্তি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত বা ট্রমায় ভুগছে। অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষক অধ্যাপক ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, কেউ অপহৃত হলে তার ওপর বেশ শারীরিক ও মানসিক ধকল যায়। নির্যাতনের ঘটনাও ঘটে। এসব তার মনে গভীরভাবে বিরূপ প্রভাব ফেলে। এতে উদ্ধার হওয়ার পর তার মধ্যে মানসিক অবসাদ থেকে যায়।
তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন সামাজিক অপরাধ বাড়ছে। এসব অপরাধ দমনে দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা যাঁর যাঁর অবস্থান থেকে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছেন না। বিশেষ করে আমরা গণমাধ্যমে যা দেখতে পাই, অল্প বয়সী তরুণ-তরুণী প্রেমের সম্পর্কের জেরে হঠাৎ করে নিখোঁজ হয়ে যায়। পরে অভিভাবকরা অপহরণ মামলা করেন। এর বাইরেও টাকা-পয়সা, ব্যক্তিগত বিরোধ বা অন্যান্য কারণে অপহরণের ঘটনা ঘটছে। এসব নিয়ন্ত্রণে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে আরো তৎপর হতে হবে।’
গত বছর নারী ও শিশুর বাইরে রাজধানীর ৮টি অপরাধ বিভাগের বিভিন্ন জোন বা থানা এলাকা থেকে ৪৯ জনকে অপহরণ করা হয়।
উদ্ধার হওয়া অপহৃত ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের সদস্যদের ভাষ্য, অপহরণের ঘটনায় প্রতিকার মেলে কম। দুর্বৃত্তরা তাদের জিম্মি করে মুক্তিপণ হিসেবে যে অর্থ নিয়ে থাকে, এতে একটি পরিবারের চরম ক্ষতি হয়। থানায় মামলা বা সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হলেও অনেক সময় সুফল পাওয়া যায় না। একই সঙ্গে হত্যার হুমকি, মারধর করা ও অস্ত্রের মুখে যে ভয়ভীতি দেখানো হয়, এতে বাকি জীবনে সে সহজে স্বাভাবিক হতে পারে না।
ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, ‘প্রতি মাসেই আটটি অপরাধ বিভাগের পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে এ ধরনের ঘটনা নিয়ন্ত্রণে জোরালো তাগিদ দিচ্ছি। এরপরও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না।’
অপহরণের পর দুজনকে হত্যা : সর্বশেষ অপহরণের শিকার দুই তরুণ হত্যা মামলা তদন্ত করতে গিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা ও অপরাধ তদন্ত বিভাগ (ডিবি) জানতে পারে, গত ৭ ডিসেম্বর থেকে ২৫ ডিসেম্বরের মধ্যে মোস্তফা ও জিহাদ নামে দুই তরুণকে অপহরণ করা হয়।
পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিদিনের মতো অটোরিকশা নিয়ে রাজধানীর দক্ষিণখানের বাসা থেকে বের হন মোস্তফা। তিনি আর বাসায় ফিরে আসেননি। তাঁকে অপহরণের পর হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ১০ দিন পর আসিয়ান সিটির ২৩ নম্বর রোডের পশ্চিম দিকের ফাঁকা প্লট থেকে তাঁর গলা কাটা লাশ উদ্ধার করা হয়। এর ১৮ দিন পর ২৫ ডিসেম্বর সকালে একই এলাকা থেকে জিহাদ নামের অন্য এক তরুণকে অপহরণ করে চক্রের সদস্যরা। চার দিন পর গাজীপুরের কালীগঞ্জের একটি নির্জন জায়গায় তাঁর লাশ পাওয়া যায়।
অপহরণের ঘটনায় ৬জনকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদে ডিবি জানতে পেরেছে, অটোরিকশা ছিনিয়ে নিতেই তাদের অপহরণ ও হত্যা করা হয়।
এ ব্যাপারে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ‘চক্রটি মূলত অটোরিকশা ভাড়া করে চালকদের নিরিবিলি স্থানে নিয়ে যেত। এরপর চালককে গলা কেটে হত্যা করে টাকা, মোবাইল ও অটোরিকশা নিয়ে চলে যেত। আমরা এমন একটি ঘটনার অভিযোগ পেয়ে তদন্ত করতে গিয়ে শিগগিরই একই ধরনের আরেকটি ক্লু-লেস হত্যার ঘটনার রহস্য উদঘাটন করি প্রথমে। এরপর এ ধরনের আরো একটি হত্যাকাণ্ডের তথ্য পাই।’
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর অসাধুরা জড়িত : অপহরণ ঘটনায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কিছু অসাধু সদস্য জড়িত। তদন্তে এর প্রমাণ মিলেছে।
আইন সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে সাদা পোশাকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর পরিচয়ে কয়েকজনকে অপহরণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। অপহৃতদের মধ্যে একজন ফিরে এসেছেন। দুজন এখনো নিখোঁজ।
১ নভেম্বর সন্ধ্যায় রাজধানীর ধানমণ্ডি এলাকা থেকে মাহবুব আলী নামের এক ব্যবসায়ী এবং একটি রাজনৈতিক দলের নেতাকে অপহরণের ঘটনায় একাধিক পুলিশ সদস্য জড়িত থাকার তথ্য-প্রমাণ পান পুলিশের তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।ওই মামলা তদন্তের দায়িত্বে থাকা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) গত ৯ নভেম্বর অপহরণে জড়িত তিন পুলিশ সদস্যসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে।
মাহবুব আলীর ভাষ্য, ১ নভেম্বর সন্ধ্যার দিকে তিনি ধানমণ্ডি এলাকায় আওয়ামী লীগের সভাপতির কার্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এক পর্যায়ে নিজেদের সিআইডি পুলিশ পরিচয় দিয়ে তাঁকে অপহরণ করে তাঁর কাছ থেকে তিন লাখ টাকা আদায় করে অপহরণকারীরা। এ ঘটনায় পুলিশের চার সদস্যসহ ছয়জন গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন।
সাম্প্রতিক ঘটনা : ৫ সেপ্টেম্বর বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এলাকা থেকে মো. মহিউদ্দিন নামের এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে অপহরণ করা হয়। বিপুল অঙ্কের টাকা লুটে ছেড়ে দেওয়া হয় তাঁকে। এ ব্যাপারে মহিউদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দিনদুপুরে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে আমাকে তাঁরা গাড়িতে ওঠায়। চোখ বেঁধে মারধর করতে থাকে, এরপর তারা হত্যার হুমকি দিয়ে ২০ লাখ টাকা লুটে নেয়।’ এ ঘটনায় রাজধানীর শাহবাগ থানায় মামলা করেন তিনি। ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। তবে এখনো লুট হওয়া টাকা উদ্ধার হয়নি।
গত ২৫ আগস্ট পুলিশ পরিচয়ে থানায় নেওয়ার কথা বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের এক ছাত্রীকে রাজধানীর কল্যাণপুর থেকে মোটরসাইকেলে অপহরণ করে তুরাগ থানার দিয়াবাড়ী এলাকায় নেওয়া হয়। ওই তরুণীর সোনার চেন ও কানের দুলসহ ব্যাগ ছিনিয়ে নেয় অপহরণকারী। র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন, র্যাব এর মধ্যে অনেক অপহরণকারীকে গ্রেপ্তার করছে। বেশ কয়েকজন অপহৃত ব্যক্তিকে উদ্ধারও করা হয়েছে। এ ধরনের অভিযোগ পেলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
এ বিষয়ে অপরাধ বিশ্লেষক নুর খান লিটন বলেন, গত এক বছরে খোদ রাজধানী থেকে এত মানুষ অপহরণের ঘটনা আতঙ্কের বিষয়। এসব ঘটনায় যে বা যারাই জড়িত থাকুক, তাদের খুঁজে বের করে বিচারের মুখে দাঁড় করানো আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর দায়িত্ব। অন্যথায় এ ধরনের অপরাধ বাড়তে থাকবে।
কক্সবাজারে সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীগুলোকে।
Leave a Reply