নিজস্ব প্রতিবেদক : লাখ টাকায় মিলছে পাসপোর্ট। আর ৩ থেকে ৪ লাখে ভিসা। এইভাবেই রোহিঙ্গা হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশি, চলে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে। বাংলাদেশি নাগরিকেরা পাসপোর্ট পেতে গলদঘর্ম হচ্ছেন। আর খুব সহজেই পাসপোর্ট পেয়ে যাচ্ছেন রোহিঙ্গারা। রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট, ভিসা পাইয়ে বাংলাদেশি বানিয়ে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার কাজে জড়িত রয়েছে বিশাল একটি চক্র।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্বাচন কমিশন ও পাসপোর্ট অফিসের কতিপয় কর্মকর্তা এ চক্রের সহযোগী। পুলিশের কিছু কর্মীও রয়েছে এ অসাধু চক্রে। অবৈধ এ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে খুব সহজেই তারা বাংলাদেশি এনআইডি কার্ড ও পাসপোর্ট পেয়ে যাচ্ছে। বৃহস্পতিবার (১৬ ফেব্রুয়ারী) এ চক্রের ৪ জনকে গ্রেফতারের পর জালিয়াত চক্র সম্পর্কে চাঞ্চল্যকার তথ্য দিয়েছেন মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা। ২ রোহিঙ্গা নাগরিকসহ গ্রেফতার জালিয়াত চক্রের ছয় জনের কাছ থেকে ৫টি বাংলাদেশি পাসপোর্ট জব্দ করা হয়েছে।
বাংলাদেশি পরিচয় দিয়ে সৌদি আরব যাওয়ার প্রাক্কালে সম্প্রতি শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার হন রোহিঙ্গা নেতা আসাদউল্লাহ। বিদেশ যাবার সব আয়োজন শেষ করেই তিনি বিমানবন্দরে যান। কিন্তু গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তাকে পাকড়াও করা হয়। রোহিঙ্গা নাগরিক হওয়ার পরেও আসাদউল্লাহ জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, ভিসা সবকিছুই পেয়ে যান। বিমানবন্দরে তার আটক হওয়ার ঘটনায় শুরু হয় তোলপাড়। এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলা তদন্ত করছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। মূলত আসাদউল্লাহর পাসপোর্ট, ভিসা পাওয়ার রহস্য উদঘাটন করতে গিয়েই এ জালিয়াত চক্রের সন্ধান পাওয়া যায়।
গ্রেফতার জালিয়াত চক্রের সদস্যরা হলেন- মো. খসরু পারভেজ, মো. তসলিম, মো. ইসমাইল, মো. ফারুক, রোহিঙ্গা নাগরিক মো. জাবের এবং রোজী আলম। এ মামলায় বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার আসাদউল্লাহকে শ্যোন অ্যারেস্ট করার কথা জানিয়েছেন ডিবির কর্মকর্তারা। তারা জানান, গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে তারা স্বীকার করেছেন দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় তাদের সহযোগীদের মাধ্যমে এ জালিয়াতি করে আসছিল। টাকার বিনিময়ে তারা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাঠাতে ভিসা পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। সংশ্লিষ্টদের টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ করেই এনআইডি ও পাসপোর্ট এবং সর্বশেষ ভিসা সংগ্রহ করে এ জালিয়াত চক্রের সদস্যরা। একটি পাসপোর্টের জন্য এক লাখ টাকা এবং ভিসা পাইয়ে দিতে তিন থেকে চার লাখ টাকা নেয় চক্রের সদস্যরা। নির্বাচন অফিস, পাসপোর্ট অফিসসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতরের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী এ চক্রের সাথে জড়িত বলেও তারা জানিয়েছে।
এর আগে গ্রেফতার আসাদউল্লাহ চট্টগ্রামের ঠিকানা ব্যবহার করে পাসপোর্ট তৈরি করেন বলে তথ্য পায় ডিবি। তার কাছে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) যেমন রয়েছে, তেমনি ওই পরিচয়পত্র ব্যবহার করে কোভিডের টিকা নেওয়ার সনদও সংগ্রহ করেছেন। আসাদউল্লাহর দাবি, পাসপোর্ট অফিসে না গিয়েই দালালের মাধ্যমে পাসপোর্ট বানিয়েছেন তিনি। তার নামে গত অক্টোবরে জাতীয় পরিচয়পত্র, ডিসেম্বরে পাসপোর্ট এবং ৪ ফেব্রুয়ারি ভিসা ইস্যু হয়। মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করায় সবকিছু হয়েছে দ্রুতগতিতে। আসাদউল্লাহ পাসপোর্টে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার ঠিকানা ব্যবহার করেছেন। আর জরুরি যোগাযোগে স্ত্রীর নাম দিয়ে নগরীর ডবলমুরিং থানার ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে, যেগুলো ভুয়া ছিল। অথচ তিনি দ্রæত এ পাসপোর্ট পেয়েছেন।
মোটা অঙ্কের টাকা পাওয়ায় এসবির কর্মকর্তারা টেবিলে বসেই পুলিশ ভ্যারিফিকেশন সম্পন্ন করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। পাসপোর্টে আসাদউল্লাহ তার বাবার নাম উল্লেখ করেছেন মমতাজুল হক, মায়ের নাম দিয়েছেন আমেনা খাতুন। তার রোহিঙ্গা নিবন্ধন কার্ডে বাবার নাম মো. কাছিস ও মায়ের নাম উল্লেখ করা হয়েছে শাহেরা খাতুন। তবে জিজ্ঞাসাবাদে সেগুলো ভুয়া বলে দাবি করেন তিনি। সৌদি আরব যেতে দুই লাখ ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে এক ব্যক্তি তাকে জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট এবং সউদি আববের ওমরাহ ভিসা সংগ্রহ করে দিয়েছেন বলে দাবি করেন আসাদউল্লাহ।
গত বছরের ২০ অক্টোবর তিনি ১০ বছর মেয়াদী ই-পাসপোর্টের আবেদন করেন এবং ৮ ডিসেম্বর তার পাসপোর্ট ইস্যু হয়। ২০৩২ সালের ২৬ নভেম্বর তার পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হবে। ২০২২ সালের ১০ অক্টোবর ইস্যু করা জাতীয় পরিচয়পত্রে নগরীর ডবলমুরিং থানার একটি বাসার ঠিকানা রয়েছে। জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়ার ১০ দিনের মধ্যেই পাসপোর্টের আবেদন করেন আসাদউল্লাহ। ডিবির হাতে গ্রেফতার চক্রের সদস্যরাই আসাদ উল্লাহকে দ্রুত সময়ে পাসপোর্ট পাইয়ে দেন বলে জানিয়েছেন ডিবির কর্মকর্তারা।
গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে আরো ৫টি পাসপোর্ট উদ্ধার করা হয়েছে। একই প্রক্রিয়ায় এসব পাসপোর্ট তৈরি করা হয়। এ চক্রের হাত ধরে কতজন রোহিঙ্গা বাংলাদেশি এনআইডি ও পাসপোর্ট এবং মধ্যপ্রাচ্যের ভিসা পেয়েছেন তা তদন্তে মাঠে নেমেছে ডিবি। আর এ জালিয়াত চক্রের সাথে সরকারি দফতরের কারা কারা জড়িত তাদেরও চিহ্নিত করা হবে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
উল্লেখ্য, এর আগে রোহিঙ্গাদের এনআইডি ও পাসপোর্ট পাইয়ের দেয়ার ঘটনায় জড়িত নির্বাচন কমিশনের বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়। তবে এসব মামলার তদন্ত আর বেশিদূর এগোয়নি।
Leave a Reply