সংবাদ ডেস্ক : শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের বৈবাহিক অবস্থা প্রকাশ করার প্রথা অসাংবিধানিক ও বৈষম্যমূলক ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। ধর্ষণের পর সন্তান জন্ম দেওয়া এক শিক্ষার্থীর ভর্তি নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা সূত্রে করা এক রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ বৃহস্পতিবার এ রায় দেন। রায়ের ফলে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তিতে শিক্ষার্থীদের বৈবাহিক অবস্থা জানাতে বাধ্য করা যাবে না বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।
‘মেয়েটি এখন কী করবে?’ শিরোনামে ২০১৭ সালের ১৪ নভেম্বর প্রথম আলোর নারীমঞ্চ পাতায় একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। এতে ধর্ষণের পর সন্তান জন্ম দেওয়া এক শিক্ষার্থীর ভর্তি জটিলতার বিষয়ে বলা হয়। প্রতিবেদনটি যুক্ত করে ধর্ষণের পর সন্তান জন্ম দেওয়া অবিবাহিত ওই শিক্ষার্থীর ভর্তিতে নার্সিং কলেজ থেকে স্বামী পরিত্যক্ত লিখতে বলার বৈধতা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ফাহরিয়া ফেরদৌস ও নাহিদ সুলতানা ওই রিট করেন।
রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০১৭ সালের ১১ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রুল দেন। রুলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে বৈবাহিক অবস্থা প্রকাশ করার প্রথা কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। অবিবাহিত অবস্থায় ধর্ষণের কারণে মা হওয়ায় তাঁর বৈবাহিক অবস্থা প্রকাশ করা নিয়ন্ত্রণে একটি অর্থপূর্ণ নীতিমালা তৈরি করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, রুলে তাও জানতে চাওয়া হয়। ওই শিক্ষার্থীকে অবিলম্বে রাজশাহী সরকারি নার্সিং কলেজে ভর্তি করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেও নির্দেশ দেওয়া হয়।
পাঁচ বছর আগে দেওয়া রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে আংশিক রুল যথাযথ (অ্যাবসলিউট) ঘোষণা করে রায় দেওয়া হয়। আদালতে রিটের পক্ষে আইনজীবী অনীক আর হক এবং রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত দাশগুপ্ত শুনানিতে ছিলেন।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত দাশগুপ্ত প্রথম আলোকে বলেন, ‘নার্সিং কলেজে এক শিক্ষার্থীর ভর্তির ক্ষেত্রে তাঁর বৈবাহিক অবস্থা জানতে চাওয়াকে কেন্দ্র করে ওই রিট করা হয়েছিল। হাইকোর্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের বৈবাহিক অবস্থা প্রকাশ করার প্রথা অসাংবিধানিক ও বৈষম্যমূলক ঘোষণা করেছেন। এ বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়ন নিয়ে কোনো আদেশ দেননি। রায়ের ফলে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ভর্তিতে বৈবাহিক অবস্থা জানাতে বাধ্য করা যাবে না।’
রায়ের পর আইনজীবী অনীক আর হক গণমাধ্যমকে বলেন, শিক্ষার ক্ষেত্রে অবিবাহিত হতে হবে, এমন কোনো শর্ত দেওয়া যায় না। অথচ নার্সিং কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে ধর্ষণের শিকার ওই শিক্ষার্থীকে স্বামী পরিত্যক্ত লিখতে বাধ্য করা হয়। শিক্ষার ক্ষেত্রে বৈবাহিক অবস্থা–সম্পর্কিত তথ্য জানতে চাওয়া অসাংবিধানিক। কেননা এতে ব্যক্তির ব্যক্তিগত গোপনীয়তা থেকে শুরু করে অন্যান্য অধিকার ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে, যে কারণে রিটটি করা হয়েছিল।
যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে রিট
‘মেয়েটি এখন কী করবে?’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভাষ্য, ২০১৩ সালের ৬ জুনের ঘটনা। তখন তিনি দশম শ্রেণিতে পড়েন। এ সময় তাঁর জীবনে ঘটে যায় এ ভয়াবহ ঘটনা। তিনি ধর্ষণের শিকার হন। ধর্ষকের সঙ্গে মেয়েটিকে বিয়ে দেওয়ার জন্য গ্রামের লোকজন চাপ দিতে থাকেন। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদে এ নিয়ে সালিসও হয়। কিন্তু সেখানে অভিযুক্ত যুবক সবকিছু অস্বীকার করেন। সালিস ভেঙে যায়। প্রতিপক্ষের হুমকির মুখে মেয়ের পরিবার মামলা করতে পারেনি। একপর্যায়ে অন্তঃসত্ত্বা হলে মেয়েটিকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান–স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি করা হয়। তখন ওসিসি থেকেই ধর্ষণ মামলা করা হয়। মামলার পর পুলিশ আসামিকে গ্রেপ্তার করে। এরপর ওই যুবক, মেয়ে ও তাঁর সন্তানের ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়, ওই যুবকই শিশুটির বাবা। আদালতে মামলার বিচার শুরু হয়। আদালত ওই মেয়েকে ‘মহিলা সহায়তা কর্মসূচি’র রাজশাহী বিভাগীয় আবাসনকেন্দ্রে পাঠানোর নির্দেশ দেন। সেখানে থাকা অবস্থায় মেয়েটির এসএসসি পরীক্ষা শুরু হয়। পরীক্ষা চলাকালে ২০১৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মেয়েটি একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। তখন মাত্র চারটি বিষয়ের পরীক্ষা হয়েছে। সন্তানকে নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থাতে দুটি পরীক্ষায় অংশ নেন। এসএসসির বাকি লিখিত ও ব্যবহারিক পরীক্ষাগুলোতে আবাসনকেন্দ্র থেকেই অংশ নেন।
সন্তান প্রসবের পর গ্রামের লোকজন তাঁদের পরিবারকে গ্রামছাড়া করতে চেয়েছিলেন। তাঁর মা তখন গ্রামের লোকজনের হাত-পায়ে ধরেন। গ্রামের লোকজন এতে নরম হন কিন্তু তাঁরা শর্ত দেন যে পরিবারটিকে গ্রামে থাকতে দেওয়া হবে, কিন্তু মেয়েটি তাঁর সন্তান নিয়ে গ্রামে ফিরতে পারবেন না। এ নিয়ে তাঁরা একটি কাগজে মেয়েটির মা–বাবার স্বাক্ষরও নেন। ফলে মেয়েটি আর সন্তান নিয়ে গ্রামে ফিরতে পারেন না। আবাসনকেন্দ্রে থাকতেই এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়। বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৪.১৯ পেয়ে এসএসসি পাস করেন। সেখান থেকেই একটি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন। কিন্তু সরকারি হেফাজতে থাকায় কলেজে যেতে পারতেন না। এজন্য বিজ্ঞান বিভাগ ছেড়ে তাঁকে মানবিক বিভাগে ভর্তি হতে হয়। আবাসনকেন্দ্রের একজন কর্মকর্তা তাঁকে বই-খাতা কিনে দেন। সেখানে সন্তান প্রতিপালনের পাশাপাশি মেয়েটি পড়াশোনা চালিয়ে যান। ২০১৬ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেন। তবে কোনো শিক্ষকের সহায়তা না পাওয়ার কারণে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিষয়ের প্রস্তুতি ভালো ছিল না। ওই বিষয়ে অকৃতকার্য হন। কিন্তু হাল ছাড়েন না। পরের বছর আবার পরীক্ষা দেন। এই পরীক্ষার আগের দিন ৯ এপ্রিল আদালতের অনুমতি নিয়ে আবাসনকেন্দ্র থেকে এক আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে ওঠেন। সেখান থেকেই পরীক্ষা দেন। পরীক্ষার পর তাঁর আর আবাসনকেন্দ্রের বন্দী জীবনে ফিরতে ভালো লাগে না। আরেক আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে আশ্রয় নেন। সেখানে প্রায় দেড় মাস কেটে যায়।
অবশেষে ওসিসির আইনজীবী আশুরা খাতুন এবং জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির রাজশাহী বিভাগীয় সমন্বয়কারী দিল সেতারা তাঁকে সাহায্য করেন। তাঁরা মেয়েটিকে বাড়িতে রেখে আসেন। এরই মধ্যে পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়। এবার জিপিএ-৩.১৭ পেয়ে উত্তীর্ণ হন তিনি। পরের বছর ২০১৭ সালের ৩০ মে আদালতের রায়ে ধর্ষকের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। রায়ে সন্তানের দায়ভার বাবাকে নিতে বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে বাবার এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির রাজশাহী বিভাগীয় সমন্বয়কারী দিল সেতারা এ মামলার আদ্যোপান্ত জানেন। তিনি বলেন, আসামিকে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এই জরিমানার টাকা আদায়ের জন্য সার্টিফিকেট মামলা করতে হয়। সেই মামলা করা হয়েছে। কিন্তু লম্বা তারিখ পড়েছে। জরিমানার টাকা কবে আদায় হবে, তা বলা যাচ্ছে না। টাকা পেলে তা থেকে রাষ্ট্র ২৫ হাজার টাকা কেটে নেবে। বাকি ৭৫ হাজার টাকা মেয়েটির পাওয়ার কথা।
এরপর মেয়েটি রাজশাহী সরকারি নার্সিং কলেজে ভর্তি হতে গেলে এই জটিলতা তৈরি হয়। কলেজের অধ্যক্ষ মনিজ্জা খাতুন মেয়েটির অবস্থার কথা শুনে বলেছিলেন, নিয়ম অনুযায়ী ভর্তি পরীক্ষার ফরম পূরণ করার সময় অবশ্যই অবিবাহিত লিখতে হবে। অথবা স্বামী পরিত্যক্ত লিখতে হবে। তাছাড়া সন্তান হওয়ার বিষয়টি পরীক্ষায় ধরা পড়বে। এক্ষেত্রে মেয়েটিকে স্বামী পরিত্যক্ত লিখতে হবে।
মেয়েটি তখন বলেছিলেন, নার্সিং কলেজে ভর্তির স্বপ্ন নিয়েই তিনি পড়াশোনা শুরু করেছিলেন। এখন এই যুদ্ধ করতে করতে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। সমাজের মানুষের কটূক্তির ভয়ে বাড়ি থেকে বাইরে বের হতে পারেন না। আর নার্সিং কলেজে ভর্তির নিয়মকানুন শুনেই তাঁর সব বিদ্যা ভুল হয়ে যাচ্ছে। তিনি পড়াশোনাই করতে পারছেন না।
Leave a Reply